গুড় কি সত্যিই চিনির চেয়ে ভালো? পুষ্টিবিদ যা বললেন, চমকে যাবেন! – এবেলা
এবেলা ডেস্কঃ
আমাদের ভারতীয় হেঁশেলে গুড়ের কদর চিরন্তন। পাঞ্জাবের ‘গুড় কি রুটি’ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের ‘তিল-গুড় লাড্ডু’—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গুড় আমাদের খাদ্যাভ্যাস আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। কিন্তু সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া আর বিভিন্ন ওয়েলনেস ইনফ্লুয়েন্সারদের দৌলতে গুড় এক নতুন স্বাস্থ্যকর সুপারফুড হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
অনেকেরই দাবি, গুড় নাকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শরীরকে ডিটক্সিফাই করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও চিনির নিরাপদ বিকল্প। কিন্তু গুড় কি সত্যিই সেই ‘গিল্ট-ফ্রি’ মিষ্টি, যা নিয়ে এত মাতামাতি চলছে?
মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এবং ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট ড. কৃতি এস ধিরওয়ানির মতে, এর উত্তরটা কিন্তু অতটাও সহজ নয়। ড. ধিরওয়ানি বলেন, “হ্যাঁ, পরিশোধিত সাদা চিনির চেয়ে গুড় অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প, কিন্তু গুড়কে কোনোভাবেই নিজে থেকে একটি ‘স্বাস্থ্যকর খাদ্য’ বলা যায় না।”
তিনি আরও বলেন, গুড় অপরিশোধিত হওয়ার কারণে এতে কিছুটা উপকারী মিনারেল, যেমন—আয়রন আর ম্যাগনেসিয়ামের মতো উপাদান থাকে, যা সাদা চিনি থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়। সে কারণেই আয়ুর্বেদ এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা একে হজম সহায়ক এবং রক্ত পরিষ্কারকারী হিসেবে ব্যবহার করতেন।
তবে বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে ড. ধিরওয়ানি সতর্ক করে বলেন, “এই হাইপটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রায়ই এড়িয়ে যায়—গুড়ের প্রায় ৯৫% উপাদানই হলো সুক্রোজ। এতে যে সামান্য পরিমাণ খনিজ থাকে, তা গুড়ে থাকা উচ্চমাত্রার চিনির ক্ষতিকর প্রভাবকে কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়।” তিনি আরও যোগ করেন, “গুড়কে সাদা চিনির চেয়ে সামান্য বেশি পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি মিষ্টি হিসেবে ভাবুন, কোনো ‘সুপারফুড’ হিসেবে নয়।”
ডায়াবেটিস রোগীরা কি গুড় খেতে পারেন?
গুড় সম্পর্কে সবচেয়ে বড় এবং বিপজ্জনক যে ভুল ধারণাটি প্রচলিত, তা হলো—এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ। ড. ধিরওয়ানি স্পষ্টভাবে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলেন, “এর উত্তর হলো ‘না’। এটি ভারতের সবচেয়ে প্রচলিত এবং বিপজ্জনক স্বাস্থ্য বিষয়ক মিথগুলোর মধ্যে একটি।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “এর পেছনের কারণ খুবই সহজ। গুড়ের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) প্রায় ৮৪, যা সাদা চিনির মতোই দ্রুত এবং অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও দ্রুত রক্তের শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। গুড় খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হঠাৎ করে বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। গুড়ে কিছু উপকারী পুষ্টি উপাদান থাকলেও, তা এর উচ্চমাত্রার চিনির প্রভাবকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট নয়।”
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ডায়াবেটিস রোগীদের সাদা চিনির মতো গুড়ও সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা উচিত।
গুড় কেনার আগে যে বিষয়গুলি মাথায় রাখবেন
যেহেতু গুড় এখন ‘ট্রেন্ডি হেলথ ফুড’, তাই এর চাহিদাও বেড়েছে। এর ফলে বাজারে গুড়ে ভেজাল মেশানোর প্রবণতাও বেড়ে গেছে। ড. ধিরওয়ানি ভেজাল প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ টিপস দিয়েছেন:
- গুড়ের টুকরো জলে মেশালে যদি সাদা তলানি পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে তাতে চকের গুঁড়ো মেশানো হয়েছে।
- গুড়ের রঙ অতিরিক্ত উজ্জ্বল বা হালকা হলুদ হলে তাতে রাসায়নিক রং মেশানো থাকতে পারে। খাঁটি গুড়ের রং সাধারণত গাঢ় বাদামি হয়।
- অতিরিক্ত স্ফটিক বা ক্রিস্টাল দেখলে বুঝবেন, তাতে বাড়তি চিনি মেশানো হয়েছে।
সবশেষে, ড. ধিরওয়ানি পরামর্শ দেন, “প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দিনে ২০-২৫ গ্রামের বেশি গুড় বা অন্য কোনো চিনি খাওয়া উচিত নয়। এটি মোটামুটি ৫ চামচের সমান।” তিনি আরও বলেন, “শিশুদের এবং ডায়াবেটিস রোগীদের গুড় খাওয়ার পরিমাণ আরও কম হওয়া উচিত, বিশেষ করে ডায়াবেটিস আক্রান্তদের গুড় সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া উচিত।”
গুড়ের একটি নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি চিনির চেয়ে কম প্রক্রিয়াজাত এবং এতে সামান্য কিছু খনিজ পদার্থও আছে। কিন্তু গুড় কোনো ‘মিরাকেল ফুড’ নয়, এটি চিনিরই একটি রূপ, যা ক্যালোরি সমৃদ্ধ এবং রক্তের শর্করা বাড়াতে সক্ষম। তাই ডায়াবেটিস আক্রান্তদের জন্য এটি বিপজ্জনক এবং বাকিদের জন্য পরিমিত ব্যবহারই এর মূলমন্ত্র।