আমেরিকা এক নীতি, ভারত-তুরস্কের জন্য দুই নীতি? ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কী? – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নেই, তখন থেকেই তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রশংসা করে আসছেন। অথচ, এরদোয়ান একই সঙ্গে ইউক্রেনকে ড্রোন দিচ্ছেন, আবার রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস কিনছেন। তিনি একদিকে ন্যাটো-র সদস্য, আবার ব্রিকস সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন, আবার সিরিয়ায় আমেরিকা-সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর ওপর আক্রমণও চালাচ্ছেন। পশ্চিমের দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তখন তুরস্ক তা মানতে রাজি হয়নি। এই সবকিছুই এরদোয়ান একসাথে সামলে চলেছেন, তবুও ট্রাম্প তার ওপর ক্ষুব্ধ নন।

বরং ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও, সেই নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী তুরস্কের একটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছিলেন।

অন্যদিকে, ভারতও তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নীতির অধীনে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। ভারত কোয়াড এবং ব্রিকস উভয়েরই অংশ। কিন্তু এক্ষেত্রে ট্রাম্পের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বছর ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প বেশ কিছু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা ভারতের স্বার্থে আঘাত করছে। যেমন, আমেরিকা ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে, অথচ তুরস্কের ওপর মাত্র ১৫ শতাংশ।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, ট্রাম্প কেন ভারতের প্রতি কঠোর আর তুরস্কের প্রতি নরম?

এরদোয়ানের প্রতি ট্রাম্পের উষ্ণতা

২৫ সেপ্টেম্বর এরদোয়ান হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। এর আগে ২০১৯ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন। এরদোয়ানের সঙ্গে জো বাইডেনের সম্পর্ক বেশ শীতল ছিল। বাইডেন প্রায়ই এরদোয়ানের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের অভিযোগ তুলতেন। কিন্তু ট্রাম্প এরদোয়ানের প্রশংসা তখন থেকেই করছেন যখন তিনি প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন না। ২০১২ সালে ইস্তাম্বুলে ট্রাম্প টাওয়ারের উদ্বোধনের সময় ট্রাম্প এরদোয়ানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘তিনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি। তুর্কি জনগণের তিনি খুব ভালো প্রতিনিধিত্ব করছেন।’

যদিও ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে আমেরিকা ন্যাটো মিত্র তুরস্ককে এফ-৩৫ ফাইটার জেট প্রোগ্রাম থেকে বাদ দিয়েছিল, কারণ তুরস্ক রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছিল। কিন্তু এরদোয়ান জুলাই মাসে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের এই মেয়াদেই এফ-৩৫-এর সরবরাহ ধীরে ধীরে শুরু হবে।

কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব

বিশেষজ্ঞদের মতে, তুরস্কের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানই এর প্রধান কারণ। তুরস্ক কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশের পথ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে কাজ করে। এই অবস্থানের কারণেই ন্যাটো তুরস্ককে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই এরদোয়ান অনেক ক্ষেত্রে নিজের মনমতো চললেও ন্যাটো তা মেনে নেয়। ভারতের ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। যদি ট্রাম্প মনে করতেন যে ভারতকে ক্ষুব্ধ করা আমেরিকার জন্য ক্ষতিকর হবে, তাহলে তিনি ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতেন না।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশ্বিনী মহাপাত্র বলেন, ট্রাম্পের সহযোগীরা ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘মোদী যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করছেন, অথচ তুরস্ক এবং চীনও রাশিয়া থেকে তেল কিনলেও তাদের জন্য এমন কথা বলা হয় না। তুরস্ক একইসঙ্গে ইউক্রেনকে ড্রোন দিচ্ছে এবং রাশিয়া থেকে তেলও কিনছে, কিন্তু ইউক্রেন বা রাশিয়ার কারোরই এরদোয়ানের সঙ্গে কোনো তিক্ততা নেই। এটি এরদোয়ানের কূটনীতির সাফল্য।

ভারত-পাক সম্পর্কও কি একটি কারণ?

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক এ কে পাশা বলেন, ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তান একটি বড় বাধা। যখনই আমেরিকা মনে করে যে ভারত নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনই তারা পাকিস্তানকে ব্যবহার করা শুরু করে। ট্রাম্প এখন ঠিক সেই কাজটিই করছেন।

অন্যদিকে, এরদোয়ান গত দুই দশকে বহু রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সংকট সফলভাবে মোকাবিলা করে বেরিয়ে এসেছেন। ২১ শতকের শুরুতে যখন তুর্কিতে সেনাবাহিনী অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল এবং প্রায়শই অভ্যুত্থান ঘটাতো, এরদোয়ান তা সম্পূর্ণরূপে দমন করতে সক্ষম হন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরদোয়ান আন্তর্জাতিক জটিল পরিস্থিতি সামাল দিতে সিদ্ধহস্ত। যখন পশ্চিমের দেশগুলো থেকে তিনি বেশি মনোযোগ পান না, তখন তিনি রাশিয়া এবং ইসলামিক দেশগুলোর দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। এরদোয়ানের এই ভারসাম্য রক্ষা করার ক্ষমতা তাকে বিশ্ব মঞ্চে এক ভিন্ন মাত্রার সম্মান এনে দিয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *