কে-ভিসা দিচ্ছে চিন, তবুও কেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পিছু হটছেন? আসল কারণ ফাঁস! – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ

চিন সম্প্রতি ‘কে-ভিসা’ নামে একটি নতুন মাল্টি-এন্ট্রি ভিসা চালু করেছে, যা বিদেশি ব্যবসায়ী নেতা, বিনিয়োগকারী এবং তরুণ এসটিইএম (STEM) বিশেষজ্ঞদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশের কঠোর ভিসা নীতির মাঝে চিন এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। বেইজিং-এর দাবি, এর ফলে তাদের দেশে ব্যবসা ও গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কেবল ভিসা সহজ করলেই কি চিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মন জয় করতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি ততটা সহজ নয়। আসল সমস্যাগুলো ভিসা প্রক্রিয়ায় নয়, বরং চিনের নিজস্ব অর্থনৈতিক, আইনি এবং রাজনৈতিক কাঠামোয় নিহিত।

মূল সমস্যা কোথায়?

ভিসা সহজ হলেও বিদেশি পেশাজীবী ও বিনিয়োগকারীদের চিনে দৈনন্দিন জীবনে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ইংরেজি ভাষার সীমিত ব্যবহার তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এছাড়াও, ইন্টারনেটে কঠোর বিধিনিষেধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত থাকা এবং কঠোর সামাজিক পরিবেশ বিদেশিদের স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে দেয় না। যারা পরিবার নিয়ে থাকতে চান, তাদের জন্য শিশুদের শিক্ষা এবং নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবার অভাবও উদ্বেগের কারণ। অর্থাৎ, শুধু ব্যবসায়িক পরিবেশ নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাই বিদেশি পেশাজীবীদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

কেন কে-ভিসা চিনের জন্য বড় লাভজনক হবে না?

১. আইন এবং ডেটা নিরাপত্তার ঝুঁকি

চিনের ডেটা এবং ইন্টেলিজেন্স আইন বিদেশি সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সংবেদনশীল তথ্য ভাগ করে নিতে বাধ্য করতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার অভাব সৃষ্টি করে।

২. প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা

আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলোর উন্নত চিপ ও এআই প্রযুক্তির ওপর কঠোর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এর ফলে বিদেশি বিশেষজ্ঞরা চিনে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি পেতে পারেন না।

৩. আস্থার সংকট

বিদেশি নাগরিকদের আকস্মিক আটক এবং রাজনৈতিক মামলার কারণে চিনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে পেশাজীবী ও বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের ব্যাপারে দ্বিধায় ভোগেন।

৪. নীতিগত অনিশ্চয়তা

গত কয়েক বছরে প্রযুক্তি এবং রিয়েল এস্টেট খাতে চিনের আকস্মিক নীতি পরিবর্তন প্রমাণ করে যে সেখানে নীতি যেকোনো সময় পরিবর্তিত হতে পারে। এটি ব্যবসার পরিবেশকে অস্থির করে তোলে।

৫. স্থায়ী বাসস্থান পাওয়া কঠিন

চিনে গ্রিন কার্ড বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। পরিবার এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভাবা মেধাবী ব্যক্তিরা এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন যেখানে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত থাকে।

৬. মেধাস্বত্ব এবং উদ্ভাবনের উদ্বেগ

চিন মেধাস্বত্বের আইন উন্নত করলেও এর বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল বলে মনে করা হয়। তাই অনেক বিদেশি সংস্থা তাদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও প্রযুক্তি চিনে আনতে দ্বিধা করে।

৭. বিকল্প এশিয়ান হাবের আকর্ষণ

ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো আরও স্থিতিশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং উন্নত ভিসা/স্থায়ী বসবাসের বিকল্প দিচ্ছে। তাই বিদেশি সংস্থা ও পেশাজীবীরা এখন চিনকে বাদ দিয়ে এই দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।

৮. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ

চিনে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ইতিমধ্যেই একটি বড় সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপক হারে বিদেশি পেশাজীবীদের সুযোগ দেওয়া রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হতে পারে।

৯. ভাষা, সেন্সরশিপ এবং সাংস্কৃতিক বাধা

কাজের পরিবেশে ভাষার প্রতিবন্ধকতা, একাডেমিক স্বাধীনতার অভাব এবং সেন্সরশিপ বিদেশি পেশাজীবীদের জন্য বড় বাধা তৈরি করে।

কে-ভিসা চালুর মাধ্যমে চিন বিশ্বকে এই বার্তা দিতে চায় যে মহামারী এবং বৈশ্বিক ধাক্কার পর তারা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে যতক্ষণ না চিন তাদের আইনকে আরও স্বচ্ছ করে, ব্যবসার জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের সুযোগ দেয়, ততক্ষণ কে-ভিসা কেবল একটি অস্থায়ী সমাধান হয়েই থাকবে, বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *