‘দৃষ্টিহীন হয়েও ভিক্ষা নয়, বেছেছেন হকারি’, কেন এই জীবন বেছে নিলেন স্বপ্না? – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ
অন্ধ কানাই পথের ‘পরে, গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে! রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ পাঠে’র সেই অন্ধ কানাই তিনি নন, ভিক্ষাও করেন না। কিন্তু গান শোনান। সেই গানের সঙ্গে মিশে থাকে তাঁর জীবনযুদ্ধের গল্প। আর তার ফাঁকেই ছোট্ট আবদার, “কিছু দরকার হলে নিয়ে যাবেন।” উৎসবের মরশুমে যখন সবাই নতুন আনন্দে মেতেছেন, তখন পেটের টানে প্রতিদিনের মতো তাঁর লড়াই চলে। দমদম রেল স্টেশনের ব্যস্ত সাবওয়ের কোণে তাঁর ভাঙা গলায় গেয়ে চলা গান যেন হাজারো মানুষকে শিখিয়ে যায় কীভাবে জীবনকে ভালোবাসতে হয়।
দমদম রেল স্টেশনের সাবওয়ের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন স্বপ্না দাস। উচ্চতায় ছোট, গায়ের রং শ্যামলা। চোখে দেখতে না পেলেও তাঁর কণ্ঠে একরাশ আত্মবিশ্বাস। পথচারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি গেয়ে চলেন আর তার ফাঁকে বলে চলেন, “ও ভাই, ও মা, একটা রুমাল নাও না! একটা পেন নেবে গো!” কেউ কেউ ফিরে তাকান, কেউ বা না তাকিয়েই চলে যান। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা যেন বলে যায়, “ভিক্ষা নয়, খেটে খাব।”
উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের কাছে থাকেন স্বপ্না। তাঁর সংসারে দুই সন্তান। স্বপ্না দৃষ্টিহীন। তাঁর স্বামীও বিশেষভাবে সক্ষম। প্রতিদিন ঘরের সব কাজ সেরে তিনি হাতে একটি সাদা ব্যাগ আর কাঁধে অন্য একটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জীবনযুদ্ধে। কখনও ভিড় ট্রেনে, কখনও নানা প্রতিবন্ধকতায় তাঁর গতি হয়তো কিছুটা শ্লথ হয়, কিন্তু তিনি থামেননি। বছরের পর বছর ধরে দৃষ্টিহীনতাকে হেলায় হারিয়ে তিনি গান শোনান আর তার মাধ্যমে বহু মানুষকে বাঁচতে শেখান।
উৎসবের মরশুমে আর উৎসব পালন করা হয় না স্বপ্নার। বরং তাঁর কাছে এখন বেশি ভিড় মানে বেশি চাপ, কম বিক্রির চাপা টেনশন। পুজোর সময় কেমন কাটে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খুব একটা ভালো না, পুজোর সময় বৃষ্টি হলে সমস্যা বাড়ে। রোজ স্টেশনে আসি। কিছু বিক্রি হয়, আবার কখনও বেশ কম। যা বিক্রি হয় তা দিয়েই সংসার চলে।”
একবার পুজোর সময় তাঁর ১০ হাজার টাকার মাল চুরি গিয়েছিল। সেদিনের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “খুব কষ্ট হয়েছিল। জানো তো, আমি ১০ হাজার টাকার মাল তুলেছিলাম। ব্যাগ রেখে যেই সরেছি, আমার ব্যাগটাই চুরি হয়ে গেল! চোখে দেখি না, তাই কেউ সুযোগ নিল। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু বাঁচতে তো হবে।”
আপনার পাশেই বহু মানুষ ভিক্ষা করছেন, আপনি সেই পথ বেছে নিলেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বপ্না বলেন, “কেন ভিক্ষা করব? আমি দৃষ্টিহীন, আমার স্বামীও প্রতিবন্ধী। কিন্তু কিছু করে যদি রোজগার হয়, তাহলে কেন বিনামূল্যে লোকের কাছে চাইব? কেন কাজ করব না?” মায়ের কাছে কী চান? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “ভালো রেখো মা, লড়াই করার শক্তি দিও শুধু।”
একের পর এক ট্রেন আসে। সাবওয়েতে গমগম করে ভিড়। ভাঙা গলায় আবার তিনি গেয়ে ওঠেন, অনুরোধের সুরেই বলে যান, “তোমারই চলার পথে, দিয়ে যেতে চাই আমি, একটু আমার ভালোবাসা।”