মুর্শিদাবাদের কিরীটেশ্বরী সতীপীঠ! যেখানে পড়েছিল দেবী সতীর মুকুট, অজানা ইতিহাস ও রহস্য – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ

বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে থাকা একাধিক সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম পবিত্র স্থান হলো মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জের কাছে অবস্থিত কিরীটেশ্বরী সতীপীঠ। প্রচলিত বিশ্বাস, ইতিহাস ও স্থাপত্যের এক অনন্য সংমিশ্রণ দেখা যায় এই শক্তিক্ষেত্রে।

পৌরাণিক কাহিনি ও নাম রহস্য

পুরাণ অনুসারে, এটি সেই স্থান যেখানে দেবী সতীর ‘কিরীট’ বা মুকুট পতিত হয়েছিল। সেই কারণেই এই পীঠের নাম ‘কিরীটেশ্বরী’ বা ‘মুকুটেশ্বরী’। সতী আত্মাহুতি দিলে শোকাহত শিব যখন তাঁর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব শুরু করেন, তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে সতীর দেহ বিভক্ত করেন। সেই দেহের অংশ ও অলঙ্কার পৃথিবীর নানা স্থানে পড়ে সতীপীঠের সৃষ্টি করে। পীঠ নির্ণয় তন্ত্রেও এই স্থানটির উল্লেখ রয়েছে, যেখানে দেবীকে ‘ভুবনেশী সিদ্ধিরূপা কিরীট-সহ’ এবং ভৈরবকে ‘সংবর্ত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে দেবীর অন্য নাম ‘বিমলা’।

মন্দিরের ইতিহাস ও স্থাপত্য

বর্তমানে কিরীটেশ্বরী সতীপীঠের মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। ইতিহাস অনুযায়ী, প্রাচীন মন্দিরটি ধ্বংস হওয়ার পর নাটোরের রানী ভবানী আনুমানিক ১১০৪ বঙ্গাব্দে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করান। পরে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় এর সংস্কার করেন। এই মন্দিরের স্থাপত্যে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামিক শিল্পরীতির এক অসাধারণ মেলবন্ধন দেখা যায়।

বর্তমানে এই অঞ্চলে তিনটি মন্দির ‘মায়ের মন্দির’ নামে পরিচিত: প্রাচীন মূল মন্দির, পুরোনো ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত নতুন মন্দির এবং গ্রামের মধ্যে অবস্থিত ‘গুপ্ত মন্দির’। প্রথম দুটি মন্দির একই প্রাঙ্গণে একটি উন্নয়ন কমিটির অধীনে পরিচালিত হয়।

দেবীর রূপ ও রহস্যময় পূজা পদ্ধতি

প্রাচীন মন্দিরে একটি উঁচু পাথরের বেদীর ওপর কালো শিলারূপে দেবীর পূজা করা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, এই বেদীই দেবীর ‘করোটি রূপ’। এই বেদীর পিছনে বৌদ্ধধর্মীয় শ্রীযন্ত্র খোদাই করা আছে। নতুন মন্দিরে পূজা করা হয় একটি মুকুট-আকৃতির শিলাখণ্ডকে। ভোরবেলা এই শিলারূপকে স্নান করানোর সময় ভক্তরা দেবীর পূর্ণ রূপ দর্শন করার সুযোগ পান।

এই পীঠের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ হলো ‘গুপ্ত মন্দির’। লোকমুখে প্রচলিত যে, দেবীর মূল ‘কিরীট’ এখানেই সুরক্ষিত রাখা আছে। প্রতিবছর দুর্গাঅষ্টমীর দিনে পুরোহিত চোখে কাপড় বেঁধে দেবীর আবরণ পরিবর্তন করেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, কেউ যদি সরাসরি দেবীর এই কিরীট দর্শন করেন, তবে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারাবেন। পৌষ মাসে এখানে একটি বিশেষ বুদ্ধমুখী মূর্তি রূপে দেবীর পূজা হয়, যা বছরের অন্য সময় দেখা যায় না।

ভোগ ও ভক্তদের প্রস্তুতি

কিরীটেশ্বরী সতীপীঠে প্রতিদিন মাছ-সহ অন্নভোগ দেওয়া হয়, যা এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। ভক্তরা আগে থেকে জানালে তাঁদের জন্য ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই স্থানটি প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায়, আশপাশে হোটেল বা খাবারের দোকান নেই। তাই ভক্তদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।

কীভাবে পৌঁছবেন?

কিরীটেশ্বরী পৌঁছতে রেলপথে হাওড়া থেকে আজিমগঞ্জ, লালবাগ কোর্ট রোড বা ডাহাপাড়া ধাম স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন ধরে আসা যায়। সেখান থেকে টোটো বা গাড়িতে প্রায় ৪–৫ কিমি পথ। সড়কপথে বহরমপুর থেকে পলসন্ডা হয়ে লালবাগের পথে এবং জলপথে মুর্শিদাবাদ ঘাট থেকে নৌকায় সাহানগর বা সাহাপাড়া নেমে টোটোর মাধ্যমে মন্দিরে পৌঁছানো যায়। ভক্তদের মতে, এই পবিত্র স্থানে পৌঁছানোর ক্লান্তি দূর হয়ে যায় দেবী দর্শনের পর।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *