ভারতের ‘চিকেন নেক’-এর কাছেই চিনের বড় চাল! তিস্তা বিতর্ক কেন এখন চরম বিপজ্জনক? – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের তিস্তা নদীর জলবন্টন বিতর্ক এবার এক নতুন মোড় নিয়েছে। এই পুরনো বিবাদে চিনের সরাসরি অংশগ্রহণ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষেরা ‘ওয়াটার জাস্টিস ফর তিস্তা’ আন্দোলনের ব্যানারে রাস্তায় নেমে চিন-সমর্থিত ‘তিস্তা মাস্টার প্ল্যান’-এর পক্ষে স্লোগান দিয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, এই বৃহৎ প্রকল্পটি কৃষি, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। তবে, নয়াদিল্লির কপালে ভাঁজ পড়েছে এই কারণেই যে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের এলাকাটি ভারতের কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’-এর খুব কাছে। মাত্র ২০-২২ কিলোমিটার চওড়া এই করিডরটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সংযোগ স্থাপনকারী প্রধান পথ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, তিস্তার তীরে চিনের উপস্থিতি কেবল বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বাড়াবে না, বরং নজরদারি ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভারতের জন্য গুরুতর কৌশলগত হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।
তিস্তার জল ও দীর্ঘদিনের বিবাদ
প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদী সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং এরপর বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে প্রবেশ করেছে। দুই দেশের কৃষি ও জীবনধারণের জন্য এই নদী এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ১৯৮৩ সালে জলবন্টন নিয়ে একটি অস্থায়ী চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১১ সালে নতুন একটি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে সেটি আটকে যায়। এরপর থেকেই বাংলাদেশ অভিযোগ করে আসছে যে ভারত পর্যাপ্ত জল ছাড়ছে না, আর বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল ছাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
চিনের প্রবেশ ও ‘মাস্টার প্ল্যান’
২০২৫ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বেজিং সফর করেন এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানেই ৫০ বছর মেয়াদি ‘তিস্তা মাস্টার প্ল্যান’ নিয়ে আলোচনা হয়। এই মহাপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নদীর খনন, বাঁধ ও নদীতীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, এবং নতুন টাউনশিপ ও পরিকাঠামো উন্নয়ন।
এই প্রকল্পটি চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এর একটি অংশ। বাংলাদেশ এই পরিকল্পনার জন্য ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণ প্রস্তাব করেছে।
আন্দোলন তুঙ্গে, কেন চায় বাংলাদেশ?
গত ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘ওয়াটার জাস্টিস ফর তিস্তা’ স্লোগান দিয়ে মশাল মিছিল করে। তাদের বক্তব্য ছিল, এই প্রকল্পটি খরা ও বেকারত্বের শিকার উত্তরাঞ্চলের জন্য জীবনরেখা হবে। বিরোধী দল বিএনপিও এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ক্ষমতায় এলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। স্থানীয় সরকারের সমর্থন চিনের বিনিয়োগকে আরও মজবুত করছে।
ভারতের উদ্বেগ: ‘চিকেন নেক’-এর নিরাপত্তা
ভারত এখনও এই বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলেও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চিন যদি এই এলাকায় পরিকাঠামো নির্মাণ শুরু করে, তবে তা ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারিতে প্রভাব ফেলবে। এর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চিনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়েও ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এদিকে, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা জল চুক্তির মেয়াদও ২০২৬ সালে শেষ হচ্ছে। ফলে তিস্তা বিতর্কের আবহে ভারত-বাংলাদেশ জলবন্টন নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
চিনের এই পদক্ষেপ কি সত্যিই ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে, নাকি এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা? পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা জরুরি।