পাকিস্তানের ‘সন্তানরা’ তাদের পাপের শাস্তি দিয়েছে, জেনে নিন কীভাবে তারা তালেবানকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু করে তুলেছিল – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ
দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি হওয়া সত্ত্বেও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সম্পর্ক দশকের পর দশক ধরে তিক্ততায় পূর্ণ। বিশেষত, ব্রিটিশ আমলে আঁকা ডুরান্ড লাইনকে আফগানিস্তান সীমান্ত হিসেবে স্বীকার না করায় এই সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে। কিন্তু যে তালেবানকে একসময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ISI) তৈরি করেছিল, সেই ‘আওলাদ’ আজ কীভাবে ইসলামাবাদের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হলো? এই পুরনো খেলার পুরো গল্পটি জানলে আজকের উত্তেজনার কারণ স্পষ্ট হবে।
আমেরিকা ও পাকিস্তানের চাল: এক ‘জিহাদী’ বীজ রোপণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব দু’টি পরাশক্তিতে বিভক্ত ছিল—আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। আফগানিস্তানের সীমান্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অনুগত সরকার চেয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার মদতে পুষ্ট কট্টর ইসলামি গোষ্ঠীগুলো সেখানে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করত। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে প্রবেশ করলে আমেরিকা তাদের হটানোর জন্য মুজাহিদীন নামে পরিচিত যোদ্ধাদের সমর্থন করে। এই কাজে আমেরিকাকে সরাসরি সাহায্য করে পাকিস্তান।
মুজাহিদীনদের ‘জিহাদ’-এর জন্য প্রস্তুত করার দায়িত্ব নেয় পাকিস্তানের আইএসআই। আমেরিকার অর্থ ও অস্ত্র সহায়তায় আইএসআই আফগান সীমান্তের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার মাদ্রাসাগুলোতে এই দরিদ্র পশতুন যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের হাতে তুলে দেয় বন্দুক। এই প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতেই তারা কট্টর ইসলামি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়।
তালেবানের জন্ম: পাকিস্তান তৈরি করল নিজের বশংবদ
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলে সেখানে পাকিস্তানের মনমতো কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং গোত্রীয় সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনতে পাকিস্তান তখন উপজাতীয় অঞ্চলের মাদ্রাসা ছাত্রদের দিকে নজর দেয়। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘জিহাদের’ মিশন দেওয়া হয়—আফগানিস্তানে শরিয়া আইন-ভিত্তিক কট্টর ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই মাদ্রাসা ছাত্রদেরই বলা হতো ‘তালিব’, আর বহুবচনে ‘তালেবান’।
১৯৯৪ সাল নাগাদ এই তালেবানরা দক্ষিণাঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। তাদের নেতা মোল্লা ওমর যুদ্ধ শেষ করে কঠোর শরিয়া আইন চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। তালেবানদের বড় অংশই পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছিল, যার পেছনে আংশিকভাবে সৌদি আরবের অর্থসাহায্য ছিল। পাকিস্তান মনে করত, তালেবান তাদের ‘পক্ষশক্তি’ হিসেবে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেখানে ভারতের প্রভাব কমাবে। তাই আইএসআই তালেবানকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশাসনিক পরামর্শ দিয়ে সর্বতোভাবে সাহায্য করে।
বিপদে পড়ল আমেরিকা, ফাঁদে পড়ল পাকিস্তান
১৯৯৬ সালের মধ্যে তালেবান কাবুলের দখল নেয় এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশের বেশিরভাগ অংশ শাসন করে। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহী তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও দেয়। কিন্তু ২০০১ সালে আল-কায়দা যখন আমেরিকায় হামলা করে, তখন আমেরিকা তালেবানের বিরুদ্ধে যায়, কারণ আল-কায়দা তালেবানের আফগানিস্তানেই আশ্রয় নিয়েছিল। অর্থাৎ, সোভিয়েতকে হটানোর জন্য আমেরিকা যে জিহাদী গোষ্ঠীগুলিকে অর্থ দিয়েছিল, সেই জঙ্গিরাই উল্টে আমেরিকাকে আঘাত করে।
এরপর আমেরিকা যখন আল-কায়দাকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তালেবানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে হামলা চালায়, তখন তালেবান যোদ্ধারা পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। এই সময়ে পাকিস্তান একটি ‘দ্বিমুখী খেলা’ শুরু করে। একদিকে তারা আমেরিকাকে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের জন্য সমর্থন দেয়, অন্যদিকে তারা তালেবানকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে।
টিটিপি: পাকিস্তান সৃষ্ট ভয়ের প্রতিচ্ছবি
এই দ্বিমুখী খেলার ফলস্বরূপ পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানসহ উপজাতীয় অঞ্চলে তালেবান-অনুপ্রাণিত স্থানীয় চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। আমেরিকান ড্রোন হামলায় নিরপরাধদের মৃত্যু এবং আমেরিকার চাপে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযান স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই স্থানীয় যোদ্ধারাও তালেবানের কট্টর মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু আমেরিকার প্রতি পাকিস্তানের সমর্থনের কারণে তারা ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
এসব ছোট ছোট চরমপন্থী গোষ্ঠী মিলে শেষ পর্যন্ত গঠিত হয় টিটিপি বা ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’। তাদের নেতা বাইতুল্লাহ মেহসুদ পাকিস্তানে কঠোর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার উৎখাত করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ, যে লক্ষ্যে পাকিস্তান আফগান তালেবানকে তৈরি করেছিল, ঠিক সেই লক্ষ্যেই এখন এই নতুন ‘তালেবান’ পাকিস্তানের মাটিতে আঘাত হানতে শুরু করে।
টিটিপি সরাসরি পাকিস্তান সরকারকে লক্ষ্য করে স্কুল, বাজার এবং সামরিক ঘাঁটিতে বোমা হামলা চালায়, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। ২০০৯ সাল নাগাদ তারা পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের কিছু অংশ দখল করে নেয়। টিটিপি আফগান তালেবানকে সমর্থন করলেও পাকিস্তানের ভূমিকার জন্য ইসলামাবাদকে শত্রু হিসেবেই গণ্য করে।
আজকের পরিস্থিতি: জন্মদাতার বিরুদ্ধেই লড়াই
২০১৫ সালে পেশোয়ারের একটি স্কুলে টিটিপি হামলায় ১৩২ জন শিশু নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান টিটিপি-র বিরুদ্ধে বড় আকারের সামরিক অভিযান শুরু করে এবং তাদের আফগান সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়। ২০২১ সালে যখন আমেরিকান সেনা চলে গেল এবং আফগান তালেবান কাবুলের দখল নিল, তখন পাকিস্তানের ধারণা ছিল সীমান্ত নিয়ন্ত্রিত হবে এবং টিটিপি দুর্বল হবে। কিন্তু ঘটল তার উল্টো।
আফগান তালেবানের জয়ে টিটিপি নতুন করে শক্তি ও সাহস পেল। তারা আফগানিস্তানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করে নিল এবং কিছু আফগান তালেবান যোদ্ধাও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। পাকিস্তানে বিস্ফোরণ, সেনা ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলা এবং অপহরণের ঘটনা তিনগুণ বেড়ে গেল।
বর্তমানে টিটিপি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ শত্রু, যারা প্রতি বছর শত শত সেনা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। তারা সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলো দখল করে চলেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পাকিস্তান আফগানিস্তানে টিটিপি-র আস্তানায় বোমাবর্ষণ করছে। এর ফলে পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের সম্পর্ক আরও খারাপ হচ্ছে, সীমান্তে সংঘর্ষও বাড়ছে।
পাকিস্তান ভেবেছিল তালেবানকে সমর্থন করলে তারা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু নিজেদের হাতে গড়া যে যোদ্ধাদের পাকিস্তান একসময় নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেই গোষ্ঠীই আজ ভিন্ন রূপে জন্মদাতার বিরুদ্ধে তার নিজের জমিতেই দাঁড়িয়ে চরম শত্রুতা করছে।