প্রেমের গল্প: ভারতের মহান পারমাণবিক বিজ্ঞানী ভাবার জীবনে সেই মহিলা কে ছিলেন, যাকে তিনি ভালোবাসতেন? – এবেলা

এবেলা ডেস্কঃ
ভারতের পরমাণু কর্মসূচির জনক ড. হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার জীবন ছিল বিজ্ঞান ও সাফল্যের আলোয় ঝলমলে, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল রহস্যে ঘেরা। দেশের স্বার্থে যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁর জীবনেও এসেছিল এক গভীর প্রেম, যা শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি। কে ছিলেন সেই নারী? কেনই বা তিনি বিয়ে করেননি? ভাবার জীবনীকার ও সমসাময়িকদের লেখা থেকে সেই কৌতূহলী প্রেমকাহিনীর টুকরোগুলি পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত জীবনে গভীর প্রেমের ইঙ্গিত
হোমি ভাবা কখনও বিয়ে করেননি। তিনি ছিলেন শিল্প, সঙ্গীত ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুরাগী। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন কিছুটা লাজুক। যদিও তাঁর ‘প্রেম কাহিনি’ নিয়ে তিনি কখনও মুখ খোলেননি, তবুও তাঁর কিছু চিঠি, ডায়েরির অংশ এবং বন্ধুদের কথায় ইঙ্গিত মেলে যে তাঁর জীবনে এক ইউরোপীয় নারী ছিলেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর গভীর মানসিক ও আবেগিক যোগ ছিল।
জীবনীকার আর. গোবিন্দরাজন ও লিউক স্লোভেনের বইয়ে বলা হয়েছে, ভাবার জীবনে এক ইউরোপীয় নারী ছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি প্যারিসে বসবাসকারী কোনো শিল্পী বা সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে ক্যামব্রিজে থাকাকালীন বা পরবর্তীকালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় ভাবার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। বন্ধুরা বলতেন, ভাবার মনে রোমান্টিক অনুভূতি ছিল, কিন্তু তিনি তা প্রকাশ্যে আনেননি। ‘বন্ধুকে লেখা’ সেই চিঠিগুলিতেই রহস্য
জানা যায়, সেই নারীর সঙ্গে ভাবার দীর্ঘ দিন ধরে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। এই পত্রালাপ ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। এই সম্পর্ক প্রকাশ্যে না আসার পেছনে সামাজিক, ধর্মীয় বা দেশের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী হওয়ার চাপ থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
১৯৩৭ সালে জেনেভা বা প্যারিস থেকে ইউরোপে ‘টু এ ফ্রেন্ড ইন ইউরোপ’ শিরোনামে লেখা তাঁর একটি চিঠির অংশ: “কয়েকবার আমি অবাক হয়ে ভাবি যে সৌন্দর্য আর বুদ্ধিমত্তা এত শান্তিতে পাশাপাশি থাকতে পারে! তোমার মধ্যে দুটোই আছে। আমি সবসময় তোমাকে মনে করি এবং যখনই করি, আমি অস্থির হয়ে উঠি।”
এছাড়াও, ১৯৩৫ সালে লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরির একটি অংশে তিনি লেখেন, “সে আজ রাতে চেলো বাজিয়েছিল এবং সেই সুর দীর্ঘক্ষণ আমার সাথে ছিল। সেই সঙ্গীতে এমন কিছু ছিল যা আমি কখনও ভুলব না।” ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই নারী ছিলেন একজন সুইস বা ফরাসি সঙ্গীতশিল্পী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ফিরে আসার পর ১৯৪১ সালে মুম্বাই থেকে লেখা অন্য একটি চিঠিতে ভাবা বন্ধুকে প্রশ্ন করেন: “জেনেভার নীল আকাশ আর সেখানকার সন্ধ্যায় মিশে যাওয়া সেই হাসি ছাড়া ভারত কেমন যেন আলাদা লাগে। বলো, তুমি কি এখনও চেলো বাজাও?” এই অংশগুলি নিশ্চিত করে যে নারীটি জেনেভায় থাকতেন এবং সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘ব্লু লেডি’ পেইন্টিং এবং আসাম্পূর্ণতার স্বীকারোক্তি
ভাবা নিজেও একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকে তাঁর আঁকা “ব্লু লেডি” নামক একটি পেন্টিং টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (TIFR) এ সংরক্ষিত আছে। ইউরোপীয় চেহারার এই নারী প্রতিকৃতিটি কাল্পনিক ছিল না, বরং বাস্তবের ছায়া ছিল বলে TIFR-এর কিউরেটর পরবর্তীকালে জানিয়েছিলেন।
১৯৬০-এর দশকে এক সহকর্মীকে লেখা চিঠিতে ভাবা ইঙ্গিত দেন কেন তিনি বিবাহ করেননি। তিনি লিখেছিলেন: “একসময় ভেবেছিলাম আমি কারও সঙ্গে জীবন ভাগ করে নিতে পারি। কিন্তু জীবনের অন্য পরিকল্পনা ছিল। সম্ভবত আমার সবচেয়ে সত্যিকারের সঙ্গী ছিল আমার ভাবনাগুলোই।” এই স্বীকারোক্তি স্পষ্ট করে যে একসময় কেউ ছিলেন, কিন্তু সেই সম্পর্ক পূর্ণতা পায়নি।
🇮🇳 দেশপ্রেমের কাছে ব্যক্তিগত জীবন তুচ্ছ
তাহলে কেন বিয়ে করলেন না তিনি? এর একাধিক কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি ভারতের পরমাণু কর্মসূচিকে প্রতিষ্ঠা করার কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে ব্যক্তিগত জীবনকে পিছিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ ভাবেন, পার্সি পরিবার কোনো ইউরোপীয় নারীকে পুত্রবধূ হিসেবে হয়তো মেনে নিত না।
ভাবার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. এইচ. গোবিন্দরাজন তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ভাবা ভারত ও বিজ্ঞানের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে দেশের কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ফ্রান্সের মঁ ব্লাঁ পর্বতমালায় বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ব্যক্তিগত নথিপত্র এবং চিঠিপত্রের বড় অংশই TIFR এবং পরিবারের কাছে গোপন রয়ে গেছে।
এই সমস্ত সূত্রগুলি ইঙ্গিত দেয় যে হোমি ভাবার প্রেম কাহিনি ছিল ভারতীয় ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শান্ত’ কিন্তু ‘সবচেয়ে গভীর’ প্রেমগুলির মধ্যে অন্যতম—যা দেশের প্রতি তাঁর অপার ভক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে অধরা থেকে গেল।